আঁধার রাতের মুসাফির (পার্ট-৫) মাশিমে ঘরে এ কোন মেহমান
যদ্ধ বিরতির বিশদিন কেটে গেছে। এ দিনগুলাে ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মতই হয়েছিল আতেকার কাছে।
ও বার বার অসহায়ের মত নিজকেই প্রশ্ন করছিল কে আলৌকিক শক্তি বলে কি আগামী পয়তাল্লিশ দিনে এ কওম অপমানকর গােলামী হে রক্ষা পাবে?
হামিদ বিন জোহরা অকস্মাৎ এসে কি আমাদের এ পয়গাম দেবেন যে তকী, মেসােপটেমিয়া আর মরক্কোর মুজাহিদরা আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসছেন।
এর জবাবে কখনাে দৃঢ়তা আর বিশ্বাসের আলােয় ঝলমলিয়ে উঠত ওর চেহারা । আবার কখনাে ডুবে যেতে হতাশার নিঃসীম আঁধারে।।
| গােধুলী এক সন্ধ্যা। আকাশের হেঁড়া মেঘেরা রাঙছিল আবীর রঙে। হঠাৎ ভেসে এল খালেদার ব্যাকুল কণ্ঠস্বরঃ আপা, আপা, মনসুরের মামা আসছেন।
চকিতে সিঁড়ির দিকে চাইল আতেকা। ছুটে এসে খালেদা তার হাত ধরে টানতে লাগল। নীচে নেমে এল দু’জন। আঙ্গিনায় কেউ নেই। আতেকার উৎকণ্ঠা দেখে হাসতে লাগল খালেদা।
ও তিনি এখানে নেই। আসুন আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। তাকে দেখেই আমি চিনে। ফেলেছি। আরাে ক’জন সওয়ার আসছে তার পিছু পিছু।
| তাকে ঠেলে দেউড়ির দিকে নিয়ে গেল খালেদা। দরজার কাছে পৌছে বললঃ উপরে আসুন। এখান থেকে দেখা যাবে না।'
দেউড়ির কাছে পৌছে এদিক ওদিক তাকিয়ে চঞ্চল হয়ে আতেকা বললঃ তাকে। কোথায় দেখেছ তুমি?
হেসে খালেদা বললঃ উপরে আসুন। ওখান থেকে দেখতে পাবেন।
সংকীর্ণ সিঁড়ি ভেঙ্গে দেউড়ির ছাদে উঠে এল ওরা। খালেদা রেলিং ধরে নীচের দিকে তাকিয়ে অনুচ্চ আওয়াজে বললঃ ‘ওদিকে দেখুন আপা। ঐ যে তারা আসছেন।
| আতেকার দৃষ্টি ছুটে গেল অল্প দূরের কাফেলার দিকে। অনিমেষ চোখে সাঈদের। দিকে তাকিয়ে রইল ও। ওরা তখন হাবেলীর পশ্চিম কোণে। পেছনে আরাে দু'জন সওয়ার।
দরজার সামনে এসে ওরা ঘােড়া থেকে নামল। চকিতে সাঈদের সঙ্গীর দিকে চোখ পড়ল আতেকার। হঠাৎ করেই স্তব্ধ হয়ে গেল ওর শিরায় খুনের সন্তরণ। তার মাথায়
নাজায় গেছেন তিনি। ফেরেননি। এখনাে। আপনি ভেতরে আসুন, তিনি এসে পড়লেন বলে!
দেউড়ি পেরিয়ে আঙ্গিনায় এল সাঈদ। ছাদের এক পাশে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছিল। আতেকা। সঙ্গীসহ মেহমানখানায় চলে গেল সাঈদ।।
ও ‘আপা, তাকে ডাকব!' খালেদা বলল। ও ‘না। খানিক অপেক্ষা করাে।
কমিনিট পর হলরুম থেকে সাঈদ বেরিয়ে এল। তাড়াতাড়ি ছাদ থেকে নেমে তার। পথ আগলে দাঁড়াল আতেকা। ঃ সাঈদ, তােমার সাথে কে এসেছে?' প্রশ্ন করল ও।।
‘ওর নাম তালহা। কার্ডিজ থেকে পালিয়ে এসেছিল। আবুল কাশিমের অফিসে কিছুদিন থেকে দোভাষীর কাজ করছে। যুদ্ধ বিরতি আলােচনায় সে-ই দোভাষীর দায়িত্ব। পালন করেছিল। কয়েকদিন আগে আমার সাথে পরিচয়। ও এসেছে ওমরের সাথে। ওমর বলল হাশিম চাচাও নাকি তাকে চেনেন। ও যখন গ্রানাডা এসেছিল, তার অতীত কাহিনী শুনে চাচা দারুণ প্রভাবিত হয়েছিলেন। এর পর আমীন বা ওবায়েদের কাছে। এলেই সে থাকত ওমরের সাথে। দেখলেও মনে হয় ও আসলেই মজলুম।।
| আজ ভোরে শুনেছি জামানত হিসেবে যাদের পাঠানাের কথা ওদের সেন্টাফের ছাউনীতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।'
আমীন এবং ওবায়েদ ওদের সাথে রয়েছে?
‘হ্যা। কথাটা শুনেই আমি ওদের বন্ধুদের সাথে দেখা করেছি। ওমরও ঘটনার । সত্যতা স্বীকার করেছে। বাড়ী এসে চাচাকে শান্তনা দেবার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা। প্রিয় লােকদের এক গােপন বৈঠকে আমায় যােগ দিতে হয়েছে। অনেক সময় লেগেছে। ওখানেই। দুপুরে যখন সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তালহাকে নিয়ে ওমর এসে বললঃ আগামীকাল বাড়ী যাবার সময় ওকে নিয়ে যেও। উজিরে আজম ওর মাধ্যমে।
আব্বাজানের কাছে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন। ওমর নিজেই তার সাথে আসতে চাইছিল । কিন্তু গ্রানাডার এ পরিস্থিতিতে ও ছুটি পায়নি।'
একটু ভেবে আতেকা বললঃ “তুমি কি নিশ্চিত ওর নামই তালহা। ৪ 'আমাকে তাে তাই বলা হয়েছে। কিন্তু তুমি এত পেরেশান কেন?” | ‘অতীত আমায় সবাইকে সন্দেহ করতে শিখিয়েছে। ওতবার কথা তােমাকে বলেছিলাম। দেখতে ঠিক এর মতই ছিল। ওতবার কানের যে স্থান আমার তীরে যখমী হয়েছিল এরও সে স্থানে কাটা। কিন্তু তার চুল দাড়ি ছিল লাল। এর দাড়ি ছাড়া চল। দেখা যাচ্ছে না। গোঁফ আর দ্রু কাল না হয়ে লাল হলে বুঝতাম, ওতবাই নিজের নাম পাল্টে তালহা হয়েছে।
| ঃ 'আতেকা, যে ঝড় বয়ে গেছে তােমার ওপর দিয়ে কঠিন প্রাণ মানুষও তা সইতে পারত না। কিন্তু মানুষকে এত সন্দেহ করা ঠিক নয়। তােমার পিতার হত্যাকারী তােমার ঘরে পা রাখার দুঃসাহস দেখাতে পারে না। তুমি নিজেই বলছ, তার গোঁফ আর ভ্র ছিল লাল। এর জখমের চিহ্ন দেখেই তুমি সন্দেহে পড়েছ। দু’জনের এক রকম হওয়া বিচিত্র নয়।'
স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল আতেকা।
ঃ সাঈদ, আসলেও আমি সন্দেহপ্রবণ হয়ে গেছি। আমি মনে করেছিলাম কৃত্রিম উপায়ে সে গোঁফের রং পাল্টে ফেলেছে। এখন ভেতরে চলাে। চাচীজান দারুণ পেরেশান।'
আতেকার সাথে হাঁটা দিল সাঈদ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা পৌছল চাচীর কাছে। সাঈদ গ্রানাডার অবস্থা শুনাল তাকে। আমীন এবং ওবায়েদের ব্যাপারে শান্তনা দিয়ে হাশিম চাচার জন্য অপেক্ষা করল কতক্ষণ। শেষে উঠতে উঠতে বললঃ সম্ভবত তিনি রাতে আসবেন না। আমাকে এবার উঠার অনুমতি দিন। ভােরেই তার খিদমতে হাজির। হব আমি। আতেকা, এখনাে মেহমানকে নিয়ে কোন সন্দেহ থাকলে আমি সাথে নিয়ে। যাচ্ছি।'
‘না, না, আমার কোন উৎকণ্ঠা নেই। ও এখানেই থাক। চাচাজান শুনলে মন খারাপ করবেন।'
| এশা পর্যন্ত সালমা হাশিমের অপেক্ষা করলেন। এক খাদেমকে বললেনঃ “সম্ভবত । তিনি আসবেন না। মেহমানের জন্য খানা পাঠিয়ে দাও।'
সালমা আতেকার সাথে কথা বলছিলেন, কামরায় প্রবেশ করল খাদেমা। ও মুনাব। এসে সােজা মেহমানখানায় চলে গেছেন। মেহমানের সাথে আলাপ শেষ করে তিনি খাবেন।'
আচম্বিত উঠে দাড়াল আতেকা।
৪ চাচীজান আমি যাচ্ছি। আমার ঘুম আসছে। ঃ 'এত তাড়াতাড়ি?' ৪ ‘আমার শরীরটা ভাল নেই। নামাজ শেষেই ঘুমিয়ে পড়ব।'
পাশের কক্ষ থেকে বেরুচ্ছিল খালেদা। ও বললঃ “আপা, আপনি বলেছিলেন গল্প শুনাবেন। আমি যাব আপনার সাথে।'
ও না, না।' চঞ্চল হয়ে বলল ও। তুমি নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ে। নামাজ শেষ করেই তােমার কাছে আসব আমি।'
'আপনি তাে নামাজ শেষ করেই শুয়ে পড়বেন। হাত ধরে তাকে অপর কক্ষে নিয়ে গেল আতেকা। বিছানায় শুইয়ে কৃত্রিম রাগের স্বরে বললঃ বাচাল মেয়ে, এখন ঘুমিয়ে পড়াে। না হয় আর কখনাে গল্প শুনাৰ না।'
তার রাগ দেখে নীরব হয়ে গেল খালেদা। আতেকা বেরিয়ে সিড়ির দিকে এগিয়ে গেল। ধড়ফড় করছিল তার দীল। নিজের কামরায় এসে দাঁড়াল ও। ঘুলঘুলিতে কান লাগিয়ে শুনতে লাগল মেহমানের আলােচনা। চাকরদের কক্ষগুলাের ছাদ থেকে এ ছিদ্রটা কয়েক গজ মাত্র উঁচু।।
হাশিম বলছিলেনঃ “তিনি এসেছেন অথচ আমি জানব না এ কি করে সম্ভব? এসব গুজবে কান দেয়া আবুল কাশিমের জন্য ঠিক নয়।
ঃ জনাব, মেহমানের কন্ঠ। হামিদ বিন জোহরার ব্যাপারে প্রথম সংবাদ ছিল, তিনি মাল্টার কয়েদখানায় বন্দী।'
ঃ “তিনি বন্দী, আবুল কাশিম কি তা জানতেন?
ঃ না, ফার্ডিনেন্ড এ খবর গােপন রেখেছিলেন। যুদ্ধ জাহাজও পাঠিয়েছিলেন তাকে আনার জন্য। মাল্টায় ফার্ডিনেন্ডের দূত হামিদ বিন জোহরা ভেবে অন্য কাউকে বন্দী করেছে কি-না, এ সন্দেহ দূর করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। তাকে সনাক্ত করার জন্য একজন গােয়েন্দাও পাঠান হয়েছিল। কয়েকদিন পর্যন্ত এ জাহাজের কোন খোঁজ-খবর ছিল না। মাল্টা থেকে সংবাদ দেয়া হয়েছিল এ জাহাজেই হামিদ বিন জোহরা রয়েছেন। আমরা ভেবেছি সম্ভবত জাহাজ কোন বিপদে পড়েছে।
সর্বশেষ সংবাদ হল, অকস্মাৎ বিদেশী তিনটি জাহাজ এ জাহাজকে আক্রমণ করে পালিয়ে গেছে। ডুবে যাওয়া জাহাজের এক মাঝি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল। সে বলেছে, একটা জাহাজে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জাহাজটি ছিল উপকুলের খুব নিকটে।'
ঃ “আপনি বলতে চাইছেন হামিদ বিন জোহরাকে তুলে নেয়ার জন্যই জাহাজ এসেছিল।
| ‘ফার্ডিনেন্ড এমন সন্দেহই করছেন। কোন বড় কারণ ছাড়া কোন জাহাজ এ ঝুঁকি নিতে পারে না।'
আঁধার রাতের মুসাফির
৫৯।
নিস্তব্ধতা নেমে এল কক্ষে। আবার মুখ খুললেন হাশিম।।
৪ ‘এখনাে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। যদি তাকে উপকুলে পৌছানাে হয়ে থাকে, খুব শীঘ্রই এখানে এসে যাবেন তিনি।
ও 'বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্রানাডা অথবা এখানে না এসে হয়ত কোন গােপন স্থানে লুকিয়ে সঠিক সময়ের ইন্তেজার করবেন তিনি। তবু এ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। তাকে এমন কিছু করতে দেয়া যাবে না যাতে ফার্ডিনেন্ড চুক্তি ভঙ্গের বাহানা খুঁজে পান।'
ও কোন ভাল খবর নিয়ে এলে তিনি হয়ত এখানে অথবা গ্রানাডা যাবেন। আর যদি লুকিয়েই থাকেন তবে আবুল কাশিমের পেরেশানীর কোন কারণ নেই।
ও তার পেরেশানীর বড় কারণ হচ্ছে, যে চারশাে জনকে জামানত হিসেবে দুশমনের হাওলা করা হয়েছে তাদের জীবন বাঁচানাের স্মাি তার। আপনারও দু'ছেলে। রয়েছে তাদের সাথে। অন্যদের ব্যাপারে না হলেও নিজের সন্তানদের জন্য নিজের। জিম্মাদারী পুরাে করবেন, আপনার উপর আবুল কাশিমের এ বিশ্বাস রয়েছে।
ঃ আবুল কাশিম কি এখনাে ভাবছেন যে, নিজের ঘর পুড়তে হামিদ বিন জোহরার হাতে আমি আগুন তুলে দেব?'
| ঃ না, তার ভয় হচ্ছে, হামিদ বিন জোহরাকে শান্ত রাখতে না পারলে, তিনি যদি কোন হাঙ্গামার সৃষ্টি করেন খৃষ্টানরা সর্বপ্রথম এ এলাকায় পাশবিক অত্যাচার চালাবে। আপনার জন্য গ্রানাডাবাসীর কোন দরদ থাকবে না। ফার্ডিনেন্ডের কয়েদখানায় আপনার। ছেলেদের যে কি অবস্থা হবে আপনিই তা ভাল বুঝেন।'
আবার নীরবতা ছেয়ে গেল কামরায়। এবারাে মুখ খুললেন শিম।।
ও কিন্তু আমি কি করতে পারি? তাকে সঠিক পথে আনবইবা কিভাবে? তিনি যদি কবিলাগুলােকে উত্তেজিত করতে পারেন, প্রকাশ্যে তার বিরােধিতা করার সাহস কারাে। হবে না।'
ঃ উজিরে আজমেরও এই কথা। তাকে বিদ্রোহ ছড়ানাের সুযােগ দেয়া যাবে না।। যত তাড়াতাড়ি পারেন তাকে খুঁজে বের করুন। বুঝিয়ে বলুন। তাকে দিয়ে ভয়ের কোন কারণ দেখা দিলে কয়েক হপ্তা অথবা কয়েক মাস তার মুখ বন্ধ করার চিন্তা ভাবনা করা যাবে।'
ঃ তাকে কি গ্রেফতার করতে চাইছেন!’
ঃ হ্যা। তাকে সােজা পথে আনতে না পারলে যে কোন পদক্ষেপ নিতে আমরা কুষ্ঠিত হব না। তাকে রাখতে হবে এমন স্থানে জনগণের কানে তার আওয়াজ যেখান থেকে পৌছবে না। গ্রানাডা পৌছে থাকলে আমরা সময় মত পদক্ষেপ নেব। এতে আমাদের কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু শহরের বাইরে উত্তেজনা ছড়ানাের চেষ্টা করলে
এ দায়িত্ব পালন করতে হবে আপনাকে। আমরা শুনেছি তার ছেলে সাঈদ এবং অরে। বয়েসী নাতি এখানেই থাকে। এরা তার দারুণ প্রিয়।
| ‘হামিদ বিন জোহরা যদি বিদ্রোহ করতে চান তবে দশ বিশটা ছেলে সন্তানের মায়া তাকে সেপথ থেকে রুখতে পারবে না।'
ও ‘এ জন্যই গ্রানাডায় সাঈদকে গ্রেফতার করা হয়নি। উজিরে আজম এমন কিছু করতে চান না যাতে লােকজন ক্ষেপে উঠতে পারে।'
ও ‘তাহলে তিনি কি করতে চাইছেন?'
ও তার ইচ্ছে প্রভাবশালী লােকদেরকে আপনি হামিদ বিন জোহরার কাছ থেকে দরে সরিয়ে রাখবেন। ফার্ডিনেন্ডের প্রতিশােধের ভয় দেখাতে পারেন কোন কোন সর্দারকে। কাউকে লােভ দেখিয়েও নীরব রাখতে পারেন। আবুল কাশিম কথা দিয়েছেন, আপনি যা চাইবেন, তাই আপনাকে দেয়া হবে। প্রয়ােজনে ফার্ডিনেন্ড এবং সুলতানের মােহর অংকিত ডকুমেন্টও দেয়া হবে আপনাকে।
আবারও নীরবতা নেমে এল কক্ষে। সমগ্র শক্তি দিয়ে চাচাকে আতেকা বলতে চাইছিল, এই আমার পিতার হত্যাকারী। ওতবা এর নাম। কিন্তু কষ্ঠ থেকে আওয়াজ বের হল না। পালাতে চাইছিল ও। কিন্তু চলার শক্তি যেন ওর নিঃশেষ হয়ে গেছে।
হাশিম বললেনঃ যদি তিনি কোন আশার খবর নিয়ে আসেন, আর লােকেরা। জানতে পারে যে আমি তার বিরােধিতা করছি, তাহলে এ এলাকায়ই আমি থাকতে পারব না।'
ঃ আপনার কোন বিপদ এলে আবুল কাশিমের বন্ধুত্বে আস্থা রাখতে পারেন। অবশ্য কোন চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই সরাসরি তার বিরােধিতা করার পরামর্শ আপনাকে দিচ্ছি না। পরিস্থিতি অনুকুলে না আসা পর্যন্ত আপনাকে গােপনে কাজ করতে হবে। আবুল কাশিমের ধারণা, যে কোন পদক্ষেপ নেয়ার পূর্বে সে আপনার পরামর্শ নেবে। তাকে যদি বাইরে বিদ্রোহ ছড়ানাের পূর্বে গ্রানাডার স্বপক্ষীয় লােকদের সঙ্গে নেবার। পরামর্শ দেন, আপনার সব পেরেশানী দূর হয়ে যাবে। কারণ গ্রানাডার বাইরে থাকলেই কেবল হামিদ বিন জোহরা আমাদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। কাল ভাের। থেকেই তার খোঁজে লােক নিয়ােগ করুন। গ্রানাডার বর্তমান পরিস্থিতি তাকে খুলে বললে সম্ভবত কোন পদক্ষেপ তিনি নেবেন না।'
ও একটু ভাবতে দিন আমাকে। সকালে আপনাকে হয়ত কোন আশার বাণী। শােনাতে পারব। তবে গ্রানাডা তার সাথে দুশমনের মত ব্যবহার করুক, কখনােই তা বরদাশত করব না আমি। ওবায়েদ আর আমীনও সম্ভবত এছাড়া অন্য কোন পথ গ্রহণ। করবে না।'
| ঃ আপনি কিভাবে ভাবতে পারলেন, গ্রানাডায় তার কোন বিপদ এলে এক মুহূর্তের জন্যও আবুল কাশিম উজির থাকতে চাইবেন? আমার ধারণা, তার চরম দুশমনও
থানায় তার ওপর হাত তুলতে সাহস করবে না। আসলে আমরা তাকে নিরাপদ ও নার রাখতে চাইছি। আমার তাে বিশ্বাস আপনার আর উজিরের চিন্তাধারায় কোন পার্থক্য নেই। এবার আপনি বিশ্রাম করুন। শেষ রাতেই আমাকে রওয়ানা করতে হবে। আপনার সাথে তখন হয়ত দেখা হবে না।'
‘আপনি ঘুম থেকে উঠলেই আমায় কাছে পাবেন। রাত্রে হয়ত এমন কোন পরিকল্পনা মাথায় আসতে পারে, যাতে আমিও আপনার সাথে রওয়ানা করব। সে যাই হােক, অবশ্যই আপনাকে বিদায় দিতে আমি আসব।'
সীমাহীন উষ্ঠা নিয়ে কক্ষে ফিরে এল আতেকা। ঘরময় পায়চারী করছিল ও।
ঃ প্রভু আমার! এখন আমি কি করব? আমি কমজোর, অসহায় । এ বাড়ীতে এক এতীম বালিকা আমি। চাচার বিরুদ্ধে এ গ্রামের কেউ আমার কোন কথা শুনবে না। মালিক আমার, চাচাকে এ অপরাধ থেকে রক্ষা করার শক্তি আমায় দাও!
লােনা পানিতে ভেজা আঁখী নিয়ে নামাজের জন্য দাঁড়াল ও। নামাজ শেষে ক্লান্ত দেহটা এলিয়ে দিল বিছানায় । দূর দিগন্ত থেকে ভেসে আসছিল মেঘের গর্জন। অনেকক্ষণ পর্যন্ত বিছানায় এপাশ-ওপাশ করল ও। হঠাৎ তার মনে হল নীচে কেউ যেন দরজায় কড়া নাড়ছে। তাড়াতাড়ি জানালা খুলে বাইরে দেখতে লাগল আতেকা।।
দ্রুত আঙ্গিনা পার হচ্ছিলেন হাশিম। একজন মশালধারী হেঁটে যাচ্ছিল তার সামনে। চোখের পলকে দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল তারা ।। | কোথায় গেলেন তিনি? হঠাৎ কি মেহমানকে কিছু বলা প্রয়ােজন অনুভব করলেন চাচা? তবে কি হঠাৎ তার বিবেক জেগে উঠেছে, যাতে এক গাদ্দারের গলা টিপে দিতে তিনি প্রস্তুত হয়েছেন? তিনি কি সকাল হওয়ার আগেই হামিদ বিন জোহরাকে তালাশ করতে চাইছেন? প্রশ্নের পর প্রশ্ন আসছিল তার মনে। কিন্তু কোন শান্তনাপ্রদ জওয়াব ছিল না একটারও। | বাজ পড়ার শব্দে কেঁপে উঠল গােটা বাড়ী। হঠাৎ করেই বাতাসের তীব্রতার সাথে শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি। তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে বিছানার পাশে এসে দাড়াল ও। এমন বর্ষায় চাচা সফর করবেন না, ভাবতে লাগল ও। সকাল পর্যন্ত বৃষ্টি থাকলে হয়ত মেহমানও থেকে যাবেন। চাচার উপস্থিতিতে সাঈদের ঘরে যাওয়াও আমার জন্য সম্ভব নয়। কিন্তু তাকেও তাে সংবাদ দেয়া জরুরী। এখন অনেক সময় ধরে মেহমানের সাথে কথা বললে ভােরে চাচাকে ঘুমুতে হবে। তিনি দরজা খুলতেই আমি বেরিয়ে যাব।
সাঈদ বলেছিল ভােরে চাচার কাছে আসবে। বৃষ্টি থামলে মসজিদে ফজর পড়েই এদিকে আসবে হয়ত। যাই হােক আমি যাবই তার কাছে। এ গাদ্দারের সাথে চাচার আলােচনার প্রতিটি শব্দ আমার শােনা দরকার ছিল। কিন্তু এখন বৃষ্টি। তাদের সব কথা। আমি শুনতে পাব না।।
এক অসহায় অস্থিরতা নিয়ে পাথরের মত স্থির হয়ে বিছানায় বসে রইল আতেকা।

No comments