Header Ads

Header ADS

আঁধার রাতের ‍মুসাফির (র্পাট-২) বেঈমানের বিষ কামড়



কপ্ননার পাখায় ভর করে অতীতে যখন ফিরে যেত আতো - তার আশা আর স্বপ্নের দুনিয়া তখন ডুবে যেত গহীন অন্ধকারে।| এক রাতে গভীর ঘুমে আচ্ছন আতেকা। ভয়ংকর শব্দে কেঁপে উঠল প্রাচীর ও অন্ধকার কক্ষ। বিমচের মত ও বিছানায় পড়ে রইল কিছুক্ষণ । ভেসে এল মানুষের ডাক চিৎকার। উঠে মাকে ডাকতে লাগল ও। সামনের কক্ষের খােলা দরজা দিয়ে ওর মায়ের ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে এলঃ আমি এখানে।

ও “কি হয়েছে আম্মা? আব্বাজান কোথায়?'

ও জানি না। এইমাত্র তিনি নীচে গেলেন। সম্ভবত দুশমন হামলা করেছে। কিন্তু আমি একটা ভয়ংকর শব্দ শুনেছি। মনে হয়েছিল ভূমিকম্প হচ্ছে।'

লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামল ও। পাশের কক্ষের ছিটকিনি খুলে অস্ত্র খুঁজতে লাগল । অন্ধকারে হাতড়ে এগিয়ে গেলেন আম্মারা। তার হাত ধরে বললেনঃ বেটি, তুমি কি করছ! তােমার আব্বাজানের হুকুম, ঘর থেকে বের হবে না। তিনি বাইরে থেকে সিড়ির দরজা বন্ধ করে গেছেন।

? ‘আম্মা, আব্বার হুকুম আমি অমান্য করব না। তার ফিরে আসা পর্যন্ত আমি পােশাক পালে নিই।'

কিছুই বললেন না আম্মারা। ধুকপুক করছিল তার দীল। পােশাক পাল্টে হাতিয়ার বাধছিল আতেকা। এক বুড়াে নওকর মশাল হাতে চারজন মহিলা আর সাতজন শিশু নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করল।


ঃ আব্বাজান কোথায়?' প্রশ্ন করল ও।। ও “তিনি নীচে। আপনাদের হুকুম দিয়েছেন দরজা বন্ধ রাখতে।

তীর-ধনু হাতে দরজার দিকে এগােল ও। কিন্তু বুড়াে সিপাই হাত বাড়িয়ে তার বাহু ধরে ফেললাে।

‘বেটি, তুমি বাইরে যেতে পারবে না। পশ্চিমের দেয়াল ভেংগে ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করছে দুশমন। আমরা ওদের হটিয়ে দিয়েছি, পরিস্থিতি ভাল নয়।

ঃ দুশমনের তােপ এখানে পৌছল কিভাবে?

ও বারুদ দিয়ে ভেতরের দেয়াল উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পাঁচিলের নীচে সুড়ং করে। বারুদ ঢুকানাে হয়েছে। গর্ত খুঁড়েছে বাইরের দুশমন নয় ভেতরের গাদ্দার।

ও ‘এ কি করে সম্ভব? পাহারাদাররা কি ঘুমিয়েছিল? | ‘বেটি, পাচিলের সাথের কামরাগুলাের একটা থেকে গর্ত খোঁড়া হয়েছে। গত ততাে বড় নয়। কিন্তু সাথের কয়েকটা কামরা মাটির সাথে মিশে গেছে।'

ঃ আমি নীচে যাব না। পাচিলের ওপর থেকে তাে তীর চালাতে পারব।' হাত ছাড়ানাের চেষ্টা করল ও কিন্তু আম্মারা এসে জড়িয়ে ধরল তাকে। ও বেটি, খােদার দিকে চেয়ে এর কথা শােন।

ও ‘পাচিলের গর্ত বন্ধ হয়ে গেলে তােমাকে বাইরে যেতে বাঁধা দেব না।' বলল বুড়াে সিপাই। কিন্তু এ মুহূর্তে তােমার পিতার হুকুম অমান্য করা ঠিক হবে না।'

| হতাশ হয়ে ও বললঃ “ঠিক আছে। আমি পাঁচিলের ওপর যাব না। বাড়ীর ছাদ তাে। নিরাপদ। কমপক্ষে ওখানে যেতে দিন।


ও ‘বেটি, ওদিকটায়ও দুশমন। তুমি কিন্তু আমাকে জিহাদে অংশ নিতে দিচ্ছ না। বলেই তিনি মশাল দেয়ালের আংটায় লাগিয়ে বেরিয়ে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলেন বাইরে থেকে।

একটু পর কিল্লার পশ্চিম দিকে কমে এল লােকজনের শােরগােল। ও মনকে প্রবােধ দিচ্ছিল এই বলে যে, সম্ভবত ওরা পিছিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর সাথে কিল্লার পূর্বদিক থেকে। ডাক-চিৎকার শুরু হলে মন বসে গেল ওর । চিৎকারের সাথে ভেসে আসছিল তরবারীর ঝনঝন শব্দ। কামরার নারী ও শিশুরা হতভম্বের মত তাকাচ্ছিল পরস্পরের দিকে। হঠাৎ কি মনে হতেই দৌড়ে পেছনের কক্ষে চলে গেল আতেকা। কক্ষে ছিল ঘরের অতিরিক্ত আসবাবপত্র এবং কাঠের বড় দু’টো সিন্দুক। সিন্দুকে দাড়িয়ে পেছন দিককার জানালা খুলে ঝুঁকে দেখতে লাগল বাইরে । দুশমনের চিহ্নও ছিল না ওখানে।।

‘বেটি, ওখানে কি করছ?’ কাছে এসে প্রশ্ন করলেন আম্মারা। ও কিছুই না আম্মাজান। বাইরে দেখছিলাম। কিন্তু এদিকে কেউ নেই।'

তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে মায়ের সাথে অন্য কামরায় ফিরে এল ও। সিড়ির। দিকে শােনা গেল লােকজনের শব্দ। কিছুক্ষণ পর ভেসে এল কারাে পায়ের আওয়াজ।।


দম বন্ধ করে সামনের কামরার দিকে চাইতে লাগল ওরা। সিড়ির দরজার সাথের হলরুমের কবাট খুলে গেল। ভেসে এল তার পিতার কণ্ঠ ‘খােদার দিকে চেয়ে সময় নষ্ট করাে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুশমন এ ঘরে পৌছে যাবে। সিডির হিফাজত কর। wদন। অনাৱা ছাদে গিয়ে দক্ষিণ পাচিলের মুহাফিজদের ডাকতে থাক। ওরা এক হিম্মত দেখালে দুশমন অতিরিক্ত ক্ষতি কি না নিয়ে ভোর হওয়ার অপেক্ষা করবে। তােমরা ওদের বের করে সবগুলাে দুয়ার বন্ধ করে দাও।'

মশাল উচিয়ে সামনের কামরার দিকে চাইতে লাগল ওরা। ধীরে ধীরে হলরুম থেকে বেরিয়ে এলেন নাসির। আম্মারা কাপা হাতে ধরে রেখেছিলেন আতেকার হাত। স্বামীকে দেখে চিৎকার দিয়ে পড়ে গেলেন তিনি। হতভম্বের মত পিতার রক্তাক্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে রইল আতেকা। নাসির আম্মারাকে তুলে শুইয়ে দিলেন বিছানায়। নিজে ক্লান্ত দেহ নিয়ে চেয়ারে বসে পড়লেন। তার দৃষ্টি আটকে রইল আম্মারার ওপর। তিনি বলছিলেনঃ ‘আম্মারা! আমি বেঁচে আছি আম্মারা। আমি বিলকুল


একজন মহিলা চিৎকার দিয়ে বললঃ “কি দেখছ তােমরা । তার খুন ঝরছে।' এগিয়ে ও চাদর দিয়ে তার রক্ত মুছতে লাগল ।

বিমূঢ় ভাব কেটে উঠতেই পাশের কামরায় ছুটে গেল আতেকা। ফিরে এল প্রাথমিক চিকিৎসা বাক্স নিয়ে। এক মহিলার হাতে মশাল দিয়ে ও বাক্স খুলতে লাগল । বুড়াে নওকর আবদুল্লাহ প্রবেশ করল কামরায় । দরজা বন্ধ করতে করতে সে বললঃ ‘শিশুদের নীচের কক্ষে নিয়ে ওদের শান্ত রাখুন।

ও খােদার দিকে চেয়ে ডাক্তার ডাকুন।' এক মহিলা বলল । ওনার ক্ষত আশংকাজনক।' | ‘এখন কোন ডাক্তার খুঁজে পাওয়া যাবে না। আতেকা, বেটি, তােমাকেই এ কাজ করতে হবে ।


কাপা হাতে পিতার মাথায় ব্যান্ডেজ করল ও। জামা ছিড়ে আরেকটা ক্ষত দেখিয়ে তিনি বললেনঃ 'বেটি জলদি করাে। সঙ্গীরা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।'

ব্যান্ডেজ বাধা শেষ হলে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তিনি ডাকলেনঃ 'আম্মারা। | চোখ খুলে স্বামীর দিকে অনিমেষ নয়নে তাকিয়ে রইলেন আম্মারা। ঠোট নড়ছিল তার কিন্তু বাক রুদ্ধ । নাসির তার মাথায় হাত বুলিয়ে, মুচকি হাসতে চাইলেন। কিন্তু দু'চোখ ভরে এল অশ্রুতে। আম্মারা তার হাত তুলে ঠোটে ঠেকালেন। ফুলে ফুলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বললেনঃ আপনার জখম?'

ঃ 'আমার জখম মামুলী। এতে তুমি ভয় পেলে?' ঃ “আব্বাজান, এখন কি হবে?' পেরেশানীর সাথে বলল আতেকা। হাত বাড়িয়ে মেয়েকে কাছে টানলেন তিনি। মেঝেয় হাঁটু গেড়ে ও মাথা রাখল

পিতার কোলে। অতি কষ্টে কান্না সংযত করছিল ও। পিতা তাকে বললেনঃ ‘আতেকা! আমার বাহাদুর বেটি। হিম্মত নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে তােমায়। বাইরের দুশমনের বিষদাঁত আমরা ভেঙ্গে দিতে পারি। কিন্তু ভেতরে লুকিয়ে থাকা গাদ্দারদের মােকাবিলা করতে পারি না। ওদের হটিয়ে দিয়েছিলাম আমরা। পাঁচিলের গর্ত লাশ দিয়ে ভরে দিয়েছিল আমার সঙ্গীরা। কিন্তু ফটক খুলে দিল গাদ্দাররা। এর ব্যাপারে সব সময়ই আমি সন্দেহ করতাম।'

ও 'আব্বাজান, লাল পশমওয়ালাকে কি আপনি সন্দেহ করেন?

৪ সন্দেহ নয়। আমরা নিশ্চিত, সে দুশমনের চর। যে স্থানে পাঁচিল উড়িয়ে দেয়া হয়েছে তা তার সঙ্গীদের কামরা। বিস্ফোরণের পূর্বে দু’জনকে কামরা থেকে বেরিয়ে দরজার দিকে যেতে পাহারাদাররা দেখেছে। বদ কিসমত, আজ ফটকের পাহারায় ছিল ওতবা। ওখানে বিশ্বস্ত ক’জন সিপাই ছিল। তাদের উপস্থিতিতে ফটক খােলা সম্ভব ছিল । কিন্তু পাঁচিল ভেঙ্গে গেলে অনেকেই ওখানে ছুটে গিয়েছিল।

নিজে এক অসহায় বালিকা এই প্রথমবার অনুভব করল ও। মাথা তুলে পিতার দিকে তাকিলে বললঃ “আব্বাজান, এখন কি হবে?'

 ঃ বেটি, এখন আমি কিছুই বলতে পারছি না। আমাদের খুনে পিয়াস মেটানাের জন্য হয়ত ভােরের অপেক্ষা করবে দুশমন। তাহলে বাইরের লােক এসে যাবে আমাদের সাহায্যে। কিন্তু লড়াই চালিয়ে যেতে থাকলে এখানে পৌঁছতে ওদের বেশী সময় লাগবে না। সঙ্গীদের সাথে থাকা আমার একান্ত প্রয়ােজন। কিন্তু বেরুবার পূর্বে তােমার কাছে প্রতিশ্রুতি নিতে চাই। আমি কি আশা করতে পারি যে তুমি ধৈর্যের পরিচয় দেবে?

ঃ আব্বাজান, কোনদিন তাে আপনার আস্থা এবং বিশ্বাসকে আহত করিনি। কিন্তু এ অবস্থায় আপনি বাইরে যেতে পারবেন না।'

 ঃ ছাদে গিয়ে বাইরের অবস্থা দেখতে চাই। খােদা না করুন বাড়ী আক্রান্ত হলে এক্ষুণি ফিরে আসব । কিন্তু তুমি থাকবে তােমার মায়ের সাথে। তােমাদের জন্য পিছনের কামরাটাই নিরাপদ। আবদুল্লাহ থাকবে তােমাদের সাথে। শিশুরা অন্ধকারে ভয় পেতে পারে, এ জন্য অন্য মশালটা জ্বেলে রাখবে। বাইরে যাতে আলাে না যায়, এজন্য জানালা বন্ধ রেখাে।'

ও কিছু বলতে চাইছিল । কিন্তু তাড়াতাড়ি তিনি বললেনঃ ‘এখন কথা বলার সময় নেই মা! আবদুল্লাহ, কি দেখছ? জলদি করাে। শিশুদের খাদ্য আর পানি ভেতরে নিয়ে যাও । আম্মারার বিশ্রামের প্রয়ােজন। তার বিছানা তুলে ওখানে বিছিয়ে দাও।

‘না আমার বিছানার প্রয়ােজন নেই। ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন আম্মারা।

খানিক পর। নারী এবং শিশুরা চলে গিয়েছিল পেছনের কামরায়। আতেকা হতভম্বের মত তখনাে নাসিরের সামনে দাড়িয়ে। পানি চাইলেন নাসির। কঢােক পান


করে হঠাৎ দাড়িয়ে গেলেন তিনি।

এখন সময় নষ্ট করাে না।' স্বামীভক্ত স্ত্রী চকিতে তার দিকে চাইল একবার। মেয়ের হাত ধরে কম্পিত পায়ে। এগিয়ে গেল অন্য কামরায়। বিশ্বস্ত সঙ্গী আবদুল্লাহর দিকে ফিরলেন নাসির।।

ঃ তুমিও যাও। দরজা বন্ধ রেখাে।

ভেতর দিক থেকে ছিটকিনি লাগাল নওকর। নাসির দরজা আটকে দিলেন বাইরে থেকে। আতেকা চিৎকার দিয়ে বলল ঃ আব্বাজান, আপনি কথা দিয়েছিলেন ছাদ থেকে ফিরে আসবেন।'

ও বেটি।' ভাঙ্গা আওয়াজে বললেন তিনি। আমার ওয়াদা ঠিক রাখার চেষ্টা করব। কি বলছি মন দিয়ে শােন। দরজা কেন বন্ধ, করলাম আবদুল্লাহ তােমাদের বলবে। আমার দেরী হয়ে গেলে তার কথা মতাে কাজ করবে। আবদুল্লাহ সেই জিনিসট। সিন্দুকের পিছনে।

ঃ আব্বাজান, আব্বাজান। ডাকতে লাগল ও। কিন্তু কোন জওয়াব এল না। আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল তার পায়ের আওয়াজ।।

| বেটি, জোরে আওয়াজ করাে না।' আবদুল্লাহ বলল। মায়ের দিকে ফিরে ও বললঃ আম্মাজান, সিন্দুকের পেছনে কি আছে আমি জানি। কিল্লা থেকে আমাদের বের করে দিতে চাইছেন আব্বা। তিনি যাবেন না আমাদের সাথে । মরণ পর্যন্ত আমরা তার সঙ্গ ছাড়ব না, এ একীন তাঁর ছিল। এজন্য তিনি দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন।'

সিন্দুকের পিছন থেকে দড়ির সিঁড়ি বের করে আবদুল্লাহ বললঃ বেটি, আমরা যখন প্রথম আসি, এ সিঁড়িটি এখানেই ছিল। কিল্লার সাবেক মুহাফিজ হয়ত ভেবেছিলেন, কোনদিন ছেলেমেয়েদের কিল্লা থেকে বের করতে হতে পারে। কিন্তু একথা ভাবতেও প্রস্তুত ছিলেন না তােমার আব্বা । তােমাদের জীবন মরনের প্রশ্ন না হলে তিনি এতটা পেরেশান হতেন না। তুমি জান, বন্দিনীদের সাথে খৃষ্টানরা কেমন ব্যবহার করে। তােমাকে গ্রানাডা কন্যা’ নামে ডাকা হয়। এসব মহিলা এবং শিশুরা দুশমনের বর্বর অত্যাচার থেকে বেঁচে যেতে পারে। দক্ষিণ পাঁচিলের পাহারাদার এতক্ষণে আলাে জ্বেলেছে । আলােতে এখানের সব অবস্থা দেখা যাবে। ওদের আসতে দেরী হবে না। কিন্তু তাদের আসার পূর্বেই যদি দুশমন আমাদের প্রতিরােধ শক্তি নিঃশেষ করে এ বাড়ীতে হামলা করে বসে, তবে আমাদের শেষ চেষ্টা হবে তােমাদের কেল্লা থেকে বের করে দেয়া। রাতে দক্ষিণের এলাকা নিরাপদ হবে তােমাদের জন্য। আমাদের গ্রাম পর্যন্ত প্রতিটি বস্তির লােকেরাই তােমাদের সাহায্য করবে। এখন বেরুনাের জন্য প্রস্তুত হও। সিড়ি ঝুলানাের জন্য জানালা খুললে মশাল নিভিয়ে ফেলা হবে। যে আগে নামবে, এদিক ওদিক না ছুটে পাচিলের কাছে অপেক্ষা করবে সঙ্গীদের। এরপর ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাবে।'ছাদের সাথে ঝুলানাে আংটার সাথে দড়ির সিড়ি বাধল আবদুল্লাহ। লড়াকদের ৎকার শােনা যাচ্ছিল বাড়ীর কাছে। নারী এবং শিশুরা তাকিয়েছিল একে অপরের দিকে দরজার ছােট্ট ছিদ্রপথে সামনের কামরার দিকে চাইল আতেকা। হঠাৎ পিছিয়ে এল - তাকাতে লাগল চৌকাঠ সােজা ওপরের ঘুলঘুলির দিকে। একটা বড় সিন্দুক ঠেলে এল দরজার কাছে। আরেকটা ছােট সিন্দুক তুলতে চাইছিল তার ওপর । কিন্তু আr না। সিন্দুকটা বেজায় ভারী। ঃ বেটি, কি করছ?' বলল আবদুল্লাহ ।

‘কিছু না। আপনি আমায় সাহায্য করুন। ঘুলঘুলি দিয়ে পাশের কামরা দে জলদি করুন। বাড়ীতে হামলা হয়েছে।'

হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইল আবদুল্লাহ। দু’জন মহিলা সাহায্য করল আতেকাকে ছােট সিন্দুক তুলে দিল বড় সিন্দুকের ওপর ।।

আতেকা তাড়াতাড়ি সিন্দুকে উঠে তাকাল ঘুলঘুলি দিয়ে । ঘুলঘুলির ছােট্ট পা অন্য কামরা অর্ধেকটা মাত্র দেখা যাচ্ছিল। ও খঞ্জর দিয়ে কয়েকটা আঘাতে কেউ ফেলল জালের খানিকটা অংশ।

আবদুল্লাহ চিৎকার দিচ্ছিলঃ তুমি কি করছ? একটু সতর্ক হও।' তার মা এবং অন্যান্য মহিলারাও বুড়াের সঙ্গে যােগ দিল।

আধ হাত পরিমাণ ছিদ্র করে খঞ্জর খাপে রাখল ও। ঘাড় ফিরিয়ে বললঃ আপনারা এত অস্থির হচ্ছেন কেন? ঘুলঘুলির সব জাল ছিড়ে ফেললেও এ ছিদ্র দিয়ে তিন বছরের একটা শিশুও বের করা যাবে না। আমি চাইছি আব্বাজান এলে যেন ভালভাবে দেখতে। পাই।'

ঃ “তিনি এখনাে কেন আসেন না। অনেক দেরী হয়ে গেল। ধরা গলা আম্মারার।।

কামরা নীরব হয়ে রইল কিছুক্ষণ। সিঁড়িতে ছুটে আসা মানুষের চিৎকার শুনে আবদুল্লাহ বললঃ ‘ওরা সিঁড়ির নীচের দিককার দরজা ভেঙ্গে ফেলছে। এবার তােমরা তৈরী হও । আতেকা, সবার আগে তােমার পালা।

ও তাড়াতাড়ি নীচে নেমে ধনু তুলতে তুলতে বললঃ না, আগে যাবে অল্প বয়েস শিশুদের মায়েরা । তারপর আমরা বাচ্চাদের নামিয়ে দেব। তারপর আম্মাজান। সবশেষে আমি।।

| দৌড়াদৌড়ির শব্দের সাথে দরজা খােলা এবং বন্ধ করার আওয়াজ এল পাসে কামরা থেকে । তাড়াতাড়ি সিন্দুকে উঠে ছিদ্রপথে চাইতে লাগল ও।।

ছ'সাত ব্যক্তিকে নিয়ে কামরায় ঢকল তার পিতা। এগিয়ে দরজার ছিটকিনি খুল খুলতে বললেনঃ 'জলদি কর আবদুল্লাহ। তােমাদের হাতে সময় বেশী নেই।

| আতেকা সিন্দুকের ওপর থেকে নামল লাফ দিয়ে। আবদলাহ সিন্দুক সরিয়ে | ফেলল দরজা। নাসিরের সাথে আরাে তিন ব্যক্তি স্ত্রী-সন্তানদের কাছে বিদায় নিতে

কামরায় ঢুকল। মহিলাদেরকে নাসির বললেনঃ “আমরা আপনাদের স্বামীদের খুঁজে পাইনি। আপনারা তাড়াতাড়ি করুন, দুশমন খুব শীঘ এখানে পৌঁছে যাবে।'

পাশের কামরার একজনের হাতে মশাল দিল আবদুল্লাহ। ছুটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে জানালা পথে সিড়ি ঝুলিয়ে দিল নীচে।

ও 'আবদুলাহ, একটা শিশুকে নিয়ে নীচে নেমে যাও।' বললেন নাসির। আবদুল্লাহ কল চোখে তার দিকে একবার তাকিয়ে একটা বাচ্চা কোলে নিতে নিতে বললঃ 'আতেকাকে বলুন যেন দেরী না করে।'

পিতার কাঁধে হাত রেখে ও আবদারের সুরে বললঃ “আব্বাজান, আপনার হুকুম আমি পালন করব। আমায় কেবল সব শেষে যাবার অনুমতি দিন। জীবন বাঁচাতে নিজের মেয়েকে প্রাধান্য দেয়া ঠিক নয়।'

৪ ‘বেটি, তুমি কিভাবে বুঝলে অন্যদের চেয়ে তােমার জীবনকে আমি বেশী গুরুত্ব দেব? হয়ত আরাে কিছু সময় আমরা দুশমনকে ঠেকিয়ে রাখতে পারব। তােমরা সবাই ততক্ষণে নিরাপদে নেমে যেতে পারবে। বাইরের কোন সাহায্য না পেলেও রাতে তােমাদের না খুঁজে ভাের হওয়ার অপেক্ষা করবে ওরা। তবুও তােমরা সড়ক থেকে দুরে থেকো। নারী এবং শিশুদের তােমার সাথে নিয়ে যাবে। পরের ব্যবস্থা করবে তােমার। চাচা। গ্রামে নিরাপদ মনে করলে তােমার মাকে নিয়ে মামা বাড়ী চলে যেও।

অতি কষ্টে কান্না রােধ করে ও বললঃ আব্বাজান, আমরা শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আপনার জন্য অপেক্ষা করব।'

দু’জন অল্প বয়েসী শিশু, তাদের মা, আম্মারা ও আতেকা ছাড়া সবাই নীচে নেমে গিয়েছিল । সিড়ির দ্বিতীয় দরজা ভাঙছিল হামলাকারীরা।

এক নওজোয়ান মশাল ছুঁড়ে ফেলল পাশের কামরায় । নাসিরের হাত টেনে চিৎকার দিয়ে বললঃ “খােদার দিকে চেয়ে আপনিও এদের সাথে বেরিয়ে যান। দুশমন বাইরের কোন সাহায্য পাবার সুযােগ আমাদের দেবে না। আপনাকে গ্রানাডার বড় প্রয়ােজন।'

| কামরা থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে নাসির বললেনঃ ‘শহীদী খুনেরও প্রয়ােজন আছে গ্রনাডার । আমার শিরায় এখনাে অনেক খুন রয়েছে।'

তাড়াতাড়ি কক্ষের কবাট বন্ধ করে তিনি ডাকলেনঃ ‘আতেকা, ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাবার চেষ্টা কর।

পিতার শেষ নির্দেশ পালন করছিল ও। বিস্ফোরণের সাথে সাথে ভেসে এল সিড়ির। দরজা ভাঙ্গার শব্দ। সাথে সাথে শােনা গেল নাসিরের কণ্ঠঃ ‘আমরা সামনের কামরায় ওদের বাধা দেয়ার চেষ্টা করব।

কতক্ষণ নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল ও। ছিটকিনি লাগিয়ে সিন্দুক ধাক্কিয়ে নিয়ে এল দরজার কাছে। উপরে দাঁড়িয়ে চাইতে লাগল সামনের শূন্য কক্ষের দিকে। এ সময় দ্বিতীয় দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করছিল হামলাকারীরা। এক মহিলা শিশুর হাত ধরে বলছিলঃ

"আম্মারা, আতেকা, জলদি এস। ওরা সব নেমে গেছে।

৪ 'আম্মাজান, আপনি যান। ও বলল। দরজা ভাঙতে বেশী সময় লাগবে না।' ৪ 'আর তুমি?' ৪ 'আমি এখুনি আসছি। আপনি জলদি করুন আম্মাজান।

অনিচ্ছা সত্বেও জানালার দিকে এগােলেন আম্মারা। কিন্তু আরেকটা বিস্ফোরণের আওয়াজে থেমে গেল তার পা। এর সাথেই শােনা গেল লড়াকুদের ডাক-চিৎকার এবং তলােয়ারের ঝনঝনানি। হতভম্বের মত খানিক দাড়িয়ে রইলেন আম্মারা। বুক চেপে ধরে বসে পড়লেন এরপর।

৪ 'আম্মাজান।' ডাকল ও। জবাব না পেয়ে ও মনে করল তিনি নীচে নেমে গেছেন । তার মন বলছিল, বেরিয়ে যাওয়া উচিৎ, দেরী করা ঠিক হবে না। ওদের কোন সাহায্য তাে করতে পারব না আমি।।

কিন্তু পিতার প্রতি ভালবাসা তার বিবেকের ফয়সালা বাতিল করে দিল। এখনাে তার আশা, কুদরতের কোন মােজেযা হয়ত পিতার জীবন রক্ষা করবে। পৌছে যাবে। বাইরের সাহায্যকারীরা। তখন পালানােরও প্রয়ােজন হবে না।

দুশমনের আঘাত ঠেকিয়ে উল্টো পায়ে পাশের কামরায় এল চার ব্যক্তি। শেষজন তার পিতা। রুমে ঢুকেই পাল্টা হামলা করলেন তিনি। দু’টো লাশ ফেলে পিছু সরে গেল। দুশমন। এক নওজোয়ান তাড়াতাড়ি ছিটকিনি লাগিয়ে দিল দরজার ।।

হামলাকারীরা এখন এ দরজা ভাঙছিল। দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। নাসির। রক্তে ভেজা তার পােশাক। দুর্বলতায় বন্ধ হয়ে আসছিল চোখ। বাকী তিনজনও আহত। একজনের গর্দান থেকে ঝরছিল রক্ত। হঠাৎ সে মাটিতে পড়ে গেল।

পিতাকে ডাকতে চাইল আতেকা। কিন্তু মুখ খােলার সাহস হল না। ধনুতে তীর। গেঁথে দরজার দিকে চাইতে লাগল ও। পেছনের কামরা থেকে আরবী ভাষায় কেউ বললঃ নাসির, আত্মহত্যা করাে না। বাজিতে তুমি হেরে গেছ। তােমার সাহায্যে কেউ আসবে না। হাতিয়ার ছেড়ে দিলে তােমার জীবন রক্ষার জিম্ম নিতে পারি।'

নাসির চিৎকার দিয়ে বললেনঃ ‘ওতবা! তুমি গাদ্দার। কওমের আজাদী তুমি বিকিয়ে দিয়েছ। কেবলমাত্র মৃত্যুই আমার তরবারী ছিনিয়ে নিতে পারে। তুমি পাবে শুধু আমার লাশ। আমাকে কিছুতেই খৃষ্টানদের গােলাম বানাতে পারবে না।'

এরপর এ দরজাও ভেঙ্গে গেল। কুড়ােল উচিয়ে এগিয়ে এল দৈত্যের মত এক খৃষ্টান। সাথে সাথে আতেকার নিক্ষিপ্ত তীর তার শাহরগ পেরিয়ে গেল। পড়ে গেল সে! পেছনের লােকেরা সরে গেল এদিক ওদিক। কিন্তু এক দঙ্গল মানুষ সঙ্গীর লাশ টপকে কামরায় প্রবেশ করল । দু’জনকে যখমী করে পিছিয়ে পিছনের কামরার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাড়ালেন নাসির। নীচে পড়ে মৃত্যুর শরবত পান করছিল তার এক সঙ্গী। বাকী। দু’জন লড়ছিল আহত সিংহের মত। তাদের তীরে যখমী হয়েছিল আরও দু’জন খৃষ্টান।


নাসির চিঙ্কার দিয়ে বলছিলেনঃ “আতেকা, আমার কথা শুন। জলদি কর আতেকা। পর হুকুম অমান্য করা তােমার উচিৎ নয়।' ১ মােশ হয়ে গেল এ আওয়াজ। ছিদ্রপথে দুশমনের সে তীর, তরবারী। এতেকা, যে তরবারী শেষ প্রতিশােধ নিচ্ছিল তার পিতার ওপর। এ শ্যে কাপছিল তার হৃদয়। চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রুরাশি। ছিল তার। বেহুশ হয়ে পড়েই যেত ও। কিন্তু পরিস্থিতির চিন্তায় অনেক


দেখছিল আতেকা, সে ব্যথাকরুণ দৃশ্যে কাঁপছি। দীল বসে যাচ্ছিল তার কষ্টেও নিজকে সংযত রাখল।
হামলাকারীদের ভীড ১ আচম্বিত তীরের আওতা থে হয়েছ। এমন ব্যক্তিকে।

রীদের ভীড় ঠেলে এগিয়ে এল ওতবা। তীর ছুঁড়তে চাইল আতেকা। . করের আওতা থেকে সরে গেল সে। সঙ্গীদের সে বললঃ “তােমরা পাগল

র ব্যক্তিকে হত্যা করলে, যাকে গ্রেফতার করলে আমাদের অনেক উপকারে

ঃ তুমি বেকুব।' ওতবা বলল জিন্দা গ্রেফতার করতে হবে।

ক্তি দরজা ধাক্কা দিয়ে বললঃ এ কামরায়ও লােকজন রয়েছে।' বকব।' ওতবা বলল। নারী ও শিশু ছাড়া এ কামরায় কেউ নেই। ওদের

র সঙ্গীদের দু’জনকে ভালভাবেই দেখতে পাচ্ছিল আতেকা। কিন্তু ওতবার। বশীর ভাগ ছিল ওদের আড়ালে। একটু দম নিয়ে আতেকাকে লক্ষ্য করে। বললও আমি জানি তুমি ভেতরে। তােমার তীরে নিহত হয়েছে আমাদের একজন ৯ ব্যক্তি। আফসােস, তােমার পিতাকে বাঁচাতে পারলাম না। হয়ত তােমার মনে আছে তােমাকে ঘরে ফিরে যাবার পরামর্শ দিয়েছিলাম। তুমি ছাড়াও তােমার মা এবং অন্যান্য নারী ও শিশুদের এখন আমি আশ্রয় দিতে পারি। আবার চোখের পলকে ভেঙ্গে ফেলতে পারি এ দুয়ার। কিন্তু বিজয়ী লশকরের অত্যাচার থেকে আমি তােমাদের বাঁচাতে চাই। যুদ্ধে আমরা হেরে গেছি। তুমি ছাড়াও স্পেনের হাজার হাজার মেয়েকে ধ্বংস থেকে আমি রক্ষা করতে চাইছি। তুমি বুদ্ধিমতী। স্পেনের মুসলমানদেরকে বরবাদীর হাত থেকে বাঁচাতে তােমার সাহায্য চাইছি। আমাকে বিশ্বাস কর । দরজা খুলে দাও। তােমাকে কয়েদী হিসেবে এ লশকরের সামনে পেশ করতে চাই না। সসম্মানে তােমায় ঘরে পৌছে দেয়ার জিম্মা আমি নিচ্ছি। তুমি থাকলে তােমার গাঁও নিরাপদ থাকবে। খােদার দিকে চেয়ে আমার প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস কর। নয়তাে আমাদের দরজাই ভাঙতে হবে।

কথা বলার সময় ওতবার সমগ্র চেহারা এল ওর সামনে। ও তীর ছুঁড়তে যাচ্ছিল, পেছনে শােনা গেল কারাে পায়ের আওয়াজ।

| ঃ আতেকা, আতেকা, তমি! ধরা গলায় বলল আবদুল্লাহ। সাথে সাথেই তার। কাপা হাত থেকে বেরিয়ে গেল তীর। আঘাত পেয়ে একদিকে সরে গেল ওতবা।। চোখের পলকমাত্র। তার কাটা কান ছাড়া আর কিছু দেখা গেল না।

তাড়াতাড়ি সিন্দুক থেকে নীচে নেমে এল ও।।

ও ‘আতেকা, আতেকা, তুমি কি করছ? খােদার দিকে চেয়ে একটু সাবধান হও। তােমার আম্মা কোথায়?'

ও আম্মা!' বিমূঢ়ের মত বলল ও। কেন তিনি নীচে যাননি?' ঃ না, খােদার দিকে চেয়ে বল কোথায় তিনি?'

চঞ্চল হয়ে এগােল ও। কিন্তু জানালার কাছে কি যেন ঠেকল পায়ে। ও হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।।

‘চাচাজান, আম্মাজান এখানে আমি জানতাম না। ভেবেছিলাম তিনি নেমে গেছেন। যাবার আগে একবার আব্বাজানকে দেখতে চাইছিলাম কিন্তু তিনি শহীদ হয়ে গেছেন।'

তাড়াতাড়ি আম্মারাকে দু'হাতের উপর তুলে নিল আবদুল্লাহ। ঃ তুমি জলদি নেমে যাও। আমি তােমার আম্মাকে রেখে যাব না। সময় নষ্ট করাে। । ওরা দরজা ভাঙছে।' বেরিয়ে যেতে যেতে ও বললঃ আপনি কি আম্মাকে নামাতে পারবেন? ঃ সে ভাবনা আমার। এখন কথা বলার সময় নয়।'

হাতে ধনু নিয়ে নামতে লাগল আতেকা। সিঁড়ির মাঝখানে এসে থেমে গেল হঠাৎ। তাকাল জানালার দিকে। জানালা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে আবদুল্লাহ। অন্ধকারেও বােঝা যাচ্ছিল, আবদুল্লাহ একা নয়। তাড়াতাড়ি নেমে গেল ও। পাঁচিলের আশপাশে কেউ নেই। ক’কদম পিছিয়ে খাদের কাছে এসে আবদুল্লাহর অপেক্ষা করতে লাগল ও।। | আম্মারাকে কাঁধে তুলে সতর্ক পা ফেলে নেমে আসছিল আবদুল্লাহ। বুক কাঁপতে। লাগল আতেকার । ধনুতে তীর গাঁথল সে। হঠাৎ জানালায় দেখা গেল আলাে। জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে এক ব্যক্তি চিৎকার জুড়ে দিল । আতেকার ধনু থেকে বেরিয়ে গেল। তীর। লােকটির হাতের মশাল গিয়ে পড়ল মাটিতে। ততােক্ষণে নীচে পৌছে গেছে। আবদুল্লাহ।

ও ‘আতেকা, গর্তে নেমে পড়।' বলল সে। এখন ওরা নিশ্চয়ই ধাওয়া করবে। আমাদের। ডান দিকের জয়তুন গাছের ফাকের সড়ক নীচে চলে গেছে।'

কিছু না বলে হাটা দিল আতেকা। কিছুক্ষণের মধ্যে সংকীর্ণ পথে নেমে এল নাচে। আম্মারা তখনাে বেহুশ। আতেকা বার বার শিরায় হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করাই " এখনাে কেন আম্মার জ্ঞান ফিরছে না?'

ও ‘বেটি, সব ঠিক হয়ে যাবে। একটু হিম্মতের সাথে কাজ কর।'

প্রায় আধ মাইল চলার পর আম্মারাকে মাটিতে শুইয়ে দিল আবদুল্লাহ। দেখছি।'

ও আমাদের সংগীরা আশপাশেই কোথাও আছে। তমি দাড়াও, আমি খুজে।


এক মহিলা পাশের ঝোপ থেকে মাথা বের করে বললঃ “তােমরা অনেক দেরী।

আমরা ভয় পাচ্ছিলাম, তােমরা না আবার অন্য পথে চলে গেছ। আম্মারাকে আবার কাধে তুলে নিল আবদুল্লাহ। শহরের পাশ দিয়ে মাইল তিনেক। aয়ে গেল । পাহাড়ে চড়ছিল ওরা। অবসন্ন হয়ে এল আবদুল্লাহর শরীর। একটু পর। ouই বিশাম নেয়া জরুরী হয়ে পড়ছিল তার।

এরা যখন পাহাড় চূড়ায়, সােহে সাদিকের আলাে ফুটে উঠল আকাশে। দেখা। cল প্রভাত তারা। আম্মারাকে মাটিতে শুইয়ে আবদুল্লাহ বললঃ এবার আমরা খানিএ বিশাম করতে পারি । সামনের উপত্যকায় যে সব বস্তি আছে ওরা পালিয়ে না গিয়ে। থাকলে আমরা সাহায্য পাব।'

ও আপনি পরিশ্রান্ত।' বলল আতেকা। অনুমতি পেলে বস্তির লােকদের ডেকে .ব। আম্মাজানের অবস্থা ভাল নয়, হয়তাে ডাক্তারও পেয়ে যাব।'

ও ‘বেটি।' ভারাক্রান্ত গলায় বলল আবদুল্লাহ। তােমাকে যেতে হবে না। নিজেই। যাব আমি । ডাক্তার প্রয়ােজন নেই তােমার মায়ের। কাধে নেয়ার সময়ই বুঝেছিলাম, জিন্দেগীর সফর তার শেষ হয়ে গেছে। তােমার মতই সারা পথে মিথ্যা শান্তনা দিয়েছি নিজেকে । তােমার আব্বাজান তােমায় কাছে নিতে চাননি। কিন্তু তােমার আম্মা চাইছিলেন, জীবনে-মরণে থাকবেন তারই সাথে।। | ব্যথা ভরা দৃষ্টিতে ও কতক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। মাথা তুলল আকাশের দিকে। দু’চোখে নেমে এল অশ্রুর বন্যা। আবদুল্লাহ বললঃ আমি যাচ্ছি। ভাের হল প্রায়। এখনাে আমরা বিপদমুক্ত নই। তােমরা ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসাে না।

ৰে

উপত্যকার দিকে হাঁটা দিল আবদুল্লাহ। কয়েক কদম পর হঠাৎ লুকিয়ে পড়ল ঝােপের আড়ালে। আতেকার দৃষ্টি ছিল মায়ের দিকে। কিন্তু আবদুল্লাহর লুকানােটা দেখল অন্য মহিলারা। এক অজানা বিপদের আশংকায় কেঁপে উঠল তাদের হৃদয়গুলাে ।

কেউ দরাজ কণ্ঠে বললঃ “তােমরা কিল্লা থেকে পালিয়ে এলে লুকানাের প্রয়ােজন। নেই। তােমাদের কথা আমরা শুনেছি।' এর সাথেই আশপাশের ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল আরাে কয়েক ব্যক্তি। হামাগুড়ি দিয়ে সঙ্গীদের কাছে ফিরে আসছিল আবদদুল্লাহ, উঠে দাঁড়াল সে।

ঃ “তােমরা কারা? ও ‘ভয় নেই, আমরা মুসলমান। এসেছি পাশের বস্তি থেকে। একজন এগিয়ে বললঃ “কিল্লায় হামলা করা হয়েছে, তা তােমরা জান?' | ‘হ্যা, বিস্ফোরণের শব্দ শুনে অনুমান করেছিলাম। এরপর পাঁচিলে আলাে দেখে। আশ্চন্ত হয়েছি। স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে দক্ষিণের চৌকির দিকে রওনা হয়ে গেছেন নাদের সর্দার। সকাল পর্যন্ত আশপাশের বস্তির স্বেচ্ছাসেবকরাও ওখানে পৌছে

যাবে।

ঃ কিল্লার মুহাফিজদের এখন কোন সাহায্য ওরা করতে পারবে না।' ও তার মানে কিল্লা দুশমনের হাতে চলে গেছে?

ও দুশমনরা কিল্লা জয় করেনি, গাদ্দাররা ফটক খুলে দিয়েছে। আমাদের সাথে। সালারের বিবির লাশ এবং তাঁর কন্যা রয়েছে।'

সওয়ার সঙ্গীকে বললঃ “এখনি গ্রাম থেকে লােকজন নিয়ে এসাে।'

তাড়াতাড়ি আতেকা বলে উঠলঃ আপনারা কি জানেন, দক্ষিণের চৌকিতে স্বেচ্ছাসেবকরা জমায়েত হচ্ছে?

ঃ হ্যা, আমাদের সর্দার এ হুকুমই দিয়েছিলেন তাদের। বিস্ফোরণের শব্দে সব বস্তিতে নাকাড়া বাজানাে শুরু হয়েছিল।'

ঃ আপনারা আমায় একটা ঘােড়া দিতে পারবেন?

ঃ আমাদের কাছে চারটে ঘােড়া আছে। সংবাদ আনা-নেয়ার জন্য একটা দােকান দরকার না হলে সবগুলােই দিতে পারতাম।

ও আমার একটা ঘােড়া প্রয়ােজন। বাড়িতে খবর দিতে চাই। আম্মাজান এবং এদের সবাইকে আপনাদের গায়ে পৌছে দিন।

: ‘খবর দেয়ার জন্য আপনার যাবার প্রয়ােজন নেই। এ দায়িত্ব আমি নিজের। জিম্মায় নিচ্ছি।' বলল একজন। আপনি আমাদের সর্দারের ঘরে চলে যান। এরপর আপনি যেতে চাইলে গায়ের সবাই আপনার সংগে যেতে প্রস্তুত থাকবে। আপনার আম্মার লাশ আপনার সাথেই বাড়ী পৌছানাের ব্যবস্থা করা হবে।

| এর সাথে একমত হল আবদুল্লাহ। কিন্তু আতেকা বললঃ না, এখুনি আমি যেতে। চাই। আব্বা আম্মাকে ভিন্ন ভিন্ন কবর দিতে দেব না আমি। আমার একীন, আমরা কিল্লা আবার কজা করতে পারব। শহীদদের কবর হবে ওখানেই। আমি যেতে চাই এ জন্য, এলাকার লােকজন যদি দায়িত্ব পালনে গাফেল হয়ে থাকে, ওদের জাগাতে পারব।

দুশমনকে আরাে ক’দিন কিল্লায় থাকতে দিলে আমরা দ্বিতীয়বার কজা করতে পারব না। এরপর এ কিল্লা হবে আরেক সেন্টাফে। দক্ষিণের সবগুলাে পথ বন্ধ হয়ে যাবে তখন।

| স্বেচ্ছাকর্মীটি ঘােড়ার লাগাম তুলে দিল আতেকার হাতে। বললঃ যদি যেতেই চান, দেরী না করাই ভাল। আমিও যাবু আপনার সংগে।' | মায়ের লাশে দৃষ্টি বুলিয়ে ঘােড়ায় সওয়ার হল ও। সংগীদের কিছু নির্দেশ দিয়ে। নওজোয়ানও চলল তার সাথে। খানিকপর এক সংকীর্ণ ঘাটি অতিক্রম করার সময় ওরা শুনছিল উপত্যকায় নাকাড়া আর ঘােড়ার খুরের শব্দ।

সূর্যোদয়ের সাথে সাথে পাহাড়ের কোলে দেখা যাচ্ছিল পদাতিক আর সওয়ার দল । হঠাৎ কিল্লার দিক থেকে ভেসে আসতে লাগল বিস্ফোরণের শব্দ। তাড়াতাড়ি ঘােড়া থামিয়ে পিছন ফিরে চাইল আতেকা। উত্তর আকাশ ছেয়ে যাচ্ছিল ধোঁয়ায় ।

ঘােড়া চটিয়ে দিল ও। নীচে জমা হওয়া লশকরের মাঝে ছিল তার চাচা। চাচাকে জড়িয়ে ধরে। কাদছিল ও। পাশে দাড়িয়ে ঠোট কামড়ে অশ্রু রােধ করছিল সাঈদ।

নিশ্চিন্তে তার কাহিনী শােনার সুযােগ হাশিমের ছিল না। কিল্লার ঘটনা তদন্তের। জন্য যে ক'জন সওয়ার গিয়েছিল, দ্রুত ফিরে এল ওরা। ওরা বললঃ ‘দুশমন কিল্লা খালি করে দিয়েছে।'

লশকরকে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দিলেন হাশিম। খানিক পর সড়কের ডানে উঁচু। পর্বত শৃংগে দাঁড়িয়ে ওরা দেখছিল কিল্লার দৃশ্য। মিলিয়ে গিয়েছিল ধুয়ার ছায়া। সে স্থানে ওপর দিকে উঠছিল লকলকে আগুনের শিখা। পাঁচিলের কোথাও বড় গর্ত। ফটকের সামনে দেখা যাচ্ছিল বিরাট স্তুপ। অধিকাংশ কামরার মত মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল সেই ঘর, যেখানে হাসি, আনন্দের দোলায় দুলেছিল আতেকার দিনগুলাে। ছুটে কিল্লার ভেতর প্রবেশ করল ও। পালিয়ে যাওয়া ক’জন সিপাই জমা হল ওখানে। স্কুপের নীচ থেকে লাশ বের করা হচ্ছিল। নাসিরের লাশ থেতলিয়ে দিয়েছিল ওরা।

ভাইয়ের লাশ গাঁয়ে নিতে চাইলেন হাশিম। কিন্তু আতেকা বললঃ আর সব শহীদদের সাথে সমাহিত হবে আমার পিতা-মাতার লাশও।'

| আম্মারার লাশ আনতে ক’জন লােক পাঠিয়ে দিলেন হাশিম। আসরের সময় স্বামীর। পাশেই দাফন করা হল তাকে।

| চাচার ঘরে সব সময়ই তার চোখে ভেসে থাকত এ বিরাণ কিল্লার ব্যাথাতুর দৃশ্য। পিতামাতার অন্তিম আবাসে ও সব সময়ই বিছিয়ে দিত মুক্তো দানার মত অশ্রু বিন্দু।

আজ উত্তরের উপত্যকা আর পাহাড়ে পাক খাওয়া সড়কের দিকে গভীর চোখে তাকিয়েছিল ও। অশ্রুরা পর্দা টেনে দিচ্ছিল চোখের সামনে।

ও ‘আম্মাজান।' অনিরুদ্ধ কান্নার গমকে মনে মনে ও বলছিল, এ নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আমায় কেন একা রেখে গেলেন?

সাথে সাথে দু'ফোটা তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়ল সামনের রেলিংয়ের ওপর।



No comments

Powered by Blogger.